***সতর্কতা: এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ আপনার জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে।

শরীরে ‘প্রচুর’ আঘাতের চিহ্ন নিয়ে ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীতে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক তরুণীর মৃত্যুর পর অভিযোগ উঠেছে, তরুণীটি পারিবারিক  নির্যাতনে নিহত হয়েছেন।

এলমা চৌধুরী মেঘলা নামের এই তরুণীটির মাস ছয়েক আগেই বিয়ে হয়েছে। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী।

তার বিভাগের শিক্ষকেরা বলছেন, সদা প্রাণবন্ত উদ্যমী তরুণীটিকে বিয়ের পরই চোখের সামনে বদলে যেতে দেখেছেন তারা। অভিযোগ উঠেছে, তাকে মোবাইল ফোন বা ফেসবুকের মত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করতে দেয়া হত না।

মিজ চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।

এ ব্যাপারে মঙ্গলবার রাতেই বনানী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন নিহত মিজ চৌধুরীর বাবা।

তাতে প্রধান আসামী করা হয়েছে তরুণীর স্বামীকে। এরই মধ্যে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুধবার তাকে আদালতে পাঠিয়ে সাতদিনের রিমাণ্ডের আবেদন জানানো হয়েছে। আদালত তিন দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেছে।

পুলিশ বলছে, নিহত তরুণীটির শরীরে ‘প্রচুর’ আঘাতের চিহ্ন ছিল।

এলমা চৌধুরী মেঘলার সহপাঠীদেরও অভিযোগ, মৃতদেহে আঘাতের দাগ দেখতে পেয়েছেন তারা।

পুলিশ বলছে, মঙ্গলবার (১৪ই ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে মিজ মেঘলার মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

কী ঘটেছিল?

বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরে আজম মিয়া বিবিসিকে বলেছেন, মঙ্গলবার (১৪ই ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় মিজ চৌধুরীর পরিবারের তরফ থেকে পুলিশকে খবর দিলে তারা ইউনাইটেড হাসপাতালে যান।

বনানীতে মিজ চৌধুরীর শ্বশুরবাড়ি থেকে সন্ধ্যায় তাকে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, হাসপাতালে আনার আগেই মেঘলার মৃত্যু হয়।

এরপরই পরিবার থেকে পুলিশে ফোন করা হয়।

পুলিশ গিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ নিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

মি. মিয়া বিবিসিকে জানিয়েছেন, সুরতহালে বলা হয়েছে মৃতদেহে আঘাতের অনেকগুলো চিহ্ন ছিল।

তিনি বলেছেন, চৌধুরীর ঘাড়ে এবং গলায় দাগ রয়েছে, যা দেখে ধারণা করা যায় যে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হতে পারে।

এছাড়া চৌধুরীর দুই হাতে, পায়ে এবং অন্যান্য স্থানেও নতুন ও পুরনো অনেক কালশিটে ছিল, যা দেখে আঘাতের দাগ বলে মনে হয় বলে পুলিশ বলছে।

মামলায় কী বলা হয়েছে?

পুলিশ কর্মকর্তা মি. মিয়া বলেছেন, মিজ চৌধুরীর বাবা মঙ্গলবার রাতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন বনানী থানায়।

এতে আসামি করা হয়েছে মিজ চৌধুরীর স্বামী, শ্বশুর ও শ্বাশুড়ীকে।

মামলার আর্জিতে বলা হয়েছে, পুলিশ বলছে, এ বছরই মেঘলার বিয়ে হয়েছিল। স্বামী কানাডায় থাকেন। বিয়ের পর মিজ চৌধুরীর বনানীতে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতেন।

গত সপ্তাহে দেশে ফেরেন তার স্বামী।

মামলায় আরো অভিযোগ করা হয়, বিয়ের পর থেকেই বিভিন্ন সময় মিজ চৌধুরীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হত।

মঙ্গলবারও শারীরিক নির্যাতনের ফলেই মিজ চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।

আর্জিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মিজ চৌধুরীর মৃতদেহে আঘাতের ‘প্রচুর’ চিহ্ন ছিল।

বিয়ের পর মিজ চৌধুরীকে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়া হত না বলেও অভিযোগ করা হয়েছে আর্জিতে।

শিক্ষক সহপাঠীদের বিক্ষোভ:

এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে মিজ মেঘলার মৃতদেহের কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে তার মুখমণ্ডলে, গলায়, হাতে এবং পায়ে অনেক কালচে দাগ দেখা যাচ্ছে।

মেঘলার সহপাঠী এবং বিয়ের আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যে হলে তিনি আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন, সেই সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীদের অনেকে ফেসবুকে অভিযোগ করে পোষ্ট দিয়েছেন মেঘলাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হত।

ফেসবুকে অনেকেই এ নিয়ে পোষ্ট দিয়েছেন।

মিজ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।

হত্যার প্রতিবাদে ও অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করেছেন নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখার অভিযোগ

নৃত্যকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মনিরা পারভীন বিবিসিকে জানান, নিহত মিজ চৌধুরী নৃত্যকলার কত্থক বিভাগের ছাত্রী ছিলেন।

মঞ্চে সাবলীল মিজ চৌধুরী ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত।

করোনাভাইরাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও, অনলাইনে বিভাগের কার্যক্রমে নিয়মিত ছিলেন মিজ চৌধুরী।

কিন্তু এ বছর বিয়ে হবার পর থেকে বিভাগের কাজকর্মে তার উপস্থিতি একেবারেই কমে যায়, পরীক্ষা দিতে আনার জন্য শিক্ষকদের রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে, বিবিসিকে বলছিলেন প্রফেসর পারভীন।

অনার্স ফাইনালের ব্যবহারিক পরীক্ষাতেও অনুপস্থিত ছিলেন তিনি।

প্রফেসর পারভীন বলেছেন, “মেঘলাকে ফোন ধরতে দেয়া হত না, এই খবরটি তারা জানতে পেরেছেন মাস দুই আগে”।

“দুই মাস আগে যখন ওদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময় হয়, তখন দেখা যায় যে চার বছরের মধ্যে কোন একটি কোর্সের পরীক্ষায় ও (মেঘলা) সহ মোট তিনজনের গ্রেড খারাপ আসছে, তাদের ওই পরীক্ষাটি আবার নিতে হবে। বাকি দুইজনকে আমরা খবর দিতে পারলেও ওকে কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না।”

“বিভাগের সহকারী যিনি একজন পুরুষ, তিনি চারদিন ফোন দিয়ে তাকে পরীক্ষার সময় জানাতে পারেননি। এরপর আমাকে জানানো হলো, কারণ আমি পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। তখন আমি বিভাগ থেকে এবং নিজের ফোন থেকে কল করি এবং টেক্সট পাঠাই, ফোন ধরেনি সে,” তিনি বলেন।

এরপর বিভাগে মিজ চৌধুরী একমাত্র যার ফোন ধরতেন, সেই ছাত্রীটির মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়।

তিনি বলেন, “যেদিন পরীক্ষা দিতে এলো সে, সেদিন জানতে পারলাম তাকে ফোন ধরতে দেয়া হয় না। বিভাগের বা তার ক্লাসের কোন ছেলের ফোন, তার বন্ধুদের ফোন—সবই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তার বন্ধুদের কাছ থেকে জানা গেল ওর ফেসবুকেও কোন অ্যাকাউন্ট নেই।”

অনার্সের ফল প্রকাশের পর প্রথমে আমাদের বলেছিল মাস্টার্স করবে না, পরে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করানো হয়।

তিনি বলেন, “এমনকি মাস্টার্সে যেদিন ভর্তি হতে আসে, সেদিন পুরোটা সময় তার স্বামী ভিডিও কলে তার সঙ্গে ছিল। মানে বিভাগে ঢোকা, ফর্ম পূরণ করা, হলে ফর্ম জমা দেয়া, ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া—প্রত্যেকটি কাজ তার স্বামী লাইভ দেখেছে। সেদিন বিষয়টি নিয়ে বিভাগে অনেকেই কথা বলাবলি করেছে।”

“মেয়েটা নৃত্যকলায় পড়ত দেখেই এত অত্যাচারের শিকার হয়েছে বলে আমাদের সন্দেহ হচ্ছে”, কলম কথা প্রতিনিধী কে বিষয়টি বলেন নৃত্যকলার সহকারী অধ্যাপিকা মনিরা পারভীন।